রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫, ১০:৪১ অপরাহ্ন

রোহিঙ্গা মাদক ব্যবসায়ী ও নাসাকা বাহিনীর হাতে হাজার হাজার সিম

তরফ নিউজ ডেস্ক : আলোচিত ও ঐতিহাসিক নাফ নদী বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারকে সীমানায় আলাদা করেছে। সম্পূর্ণ আলাদা ভূখন্ড, রাষ্ট্র, সরকার থেকে শুরু করেই প্রায় সবকিছুই ভিন্ন। অথচ এখানে মুঠোফোনের (মোবাইল ফোন) টাওয়ারের নেটওয়ার্ক কিন্তু আলাদা হয়নি। নাফ নদীর ঠিক তীরেই বাংলাদেশের সীমানায় স্থাপন করা হয়েছে একাধিক মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক কোম্পানির ফ্রিকোয়েন্সি টাওয়ার। নাফ নদীর পাড়ে যেখানে বলতে তেমন কোনো বসতিও নেই। একপাশে পানি, অন্যপাশে বনজঙ্গল। তার মধ্যেই মোবাইল ফোনের টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে কার স্বার্থে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। জবাবে যা পাওয়া গেছে তা হলো, নাফ নদীতীরের এসব টাওয়ারের ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ওই সীমান্ত এলাকার মাদকচক্র। এটি মূলত ‘ইয়াবা নেটওয়ার্ক’ হিসেবেই ব্যবহার হয়ে আসছে।

সরেজমিন গত বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) টেকনাফের নাফ নদীতীরে গিয়ে এমন কয়েকটি মোবাইল ফোনের টাওয়ার দেখা গেছে। এ সময় স্থানীয়রা বলেছেন, এটি টেকনাফের স্থানীয়দের ফোনের নেটওয়ার্ক সুবিধার জন্য স্থাপন করা হয়নি। কেননা স্থাপন করা অন্তত দুটি টাওয়ারের সন্নিকটে তেমন বসতবাড়িও নেই। যখন জোয়ারের প্রভাব বেশি থাকে তখন ওই টাওয়ারের গোড়ায়ও পানি চলে আসে। এটা নদীর একেবারেই তীরে স্থাপন করা হয়েছে। নাফ নদীর অন্যপ্রান্তে (মিয়ানমারের মন্ডুপ) সীমানার অবস্থান টাওয়ার থেকে তিন থেকে চার কিলোমিটার। অর্থাৎ সহজেই বোঝা যায়, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের প্রভাবশালী মাদকচক্রের চোরাচালানের সুবিধার জন্য এবং ‘ইয়াবা নেটওয়ার্ক’ শক্তিশালী রাখার স্বার্থেই সীমান্তে নদীর তীরে মোবাইল ফোনের এই টাওয়ার বসানো হয়েছে। যেখানে জনবসতি নেই, শুধু পাহাড় আর জঙ্গল। কয়েক বছর আগে ইয়াবার কথিত গডফাদার স্থানীয় সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির নির্দেশেই এসব টাওয়ার নাফ নদীর তীরে স্থাপন করা হয়েছিল বলেও অভিযোগ করে স্থানীয়রা। প্রায় অভিন্ন মন্তব্য করেন টেকনাফে কর্মরত বিভিন্ন বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তাও। তবে এ ব্যাপারে কথা বলতে টেকনাফে গিয়ে ও বিভিন্নভাবে সাবেক এমপি বদির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, টেকনাফে নানা কৌশলে এক সময় ভয়াবহ আকারে ইয়াবা ব্যবসা চলছিল। তবে সেই দৃশ্যপট এখন আর নেই। ওই টাওয়ারের মাধ্যমে ফোনে যোগাযোগ করেও ইয়াবা কারবারিরা তাদের অপকর্ম চালিয়েছে। বর্তমানে ওইসব টাওয়ারের ফ্রিকোয়েন্সি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জেনেছেন। ইকবাল হোসেন বলেন, পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অভিযানের ফলে স্থানীয় মাদকচক্রের তৎপরতা অনেকাংশেই কমে গেছে। বর্তমানে রোহিঙ্গারা ইয়াবা কারবারে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। এ বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতিতে অভিযান চলছে, চলবে।

নাফ নদীর তীরে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে গিয়ে দেখা গেছে, বাংলাদেশের টেকনাফ সীমানায় পাহাড়ের পাদদেশে নাফ নদীর তীরে বলতে গেলে পানি সংলগ্ন স্থানেই ‘রবি’র নেটওয়ার্ক টাওয়ার। তার পাশেই বাংলালিংক। অপরদিকে সাবেক এমপি বদির বাড়ির পূর্বদিকে নাফ নদীর অদূরবর্তী স্থানে রয়েছে আরও কয়েকটি মোবাইল ফোনের টাওয়ার।

ওইদিন টেকনাফে নাফ নদীর জেটিতে অবস্থানকালে সেখানে টহলে আসা র‌্যাব-১৫ ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তা সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার সারুয়ার সময়ের আলোকে বলেন, এসব টাওয়ার মূলত বাংলাদেশি সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক কোম্পানির সিম নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের মাদক ব্যবসায়ী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অনেকেই ব্যবহার করে থাকে বলে অভিযোগ আছে। ওইসব অভিযোগের পর এসব টাওয়ারের ফ্রিকোয়েন্সি সীমা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে শুনেছেন তিনি। যদিও আমি এই ব্যাটালিয়নে নতুন এসেছি, তবে নদীর পারে বনজঙ্গলের পাশে এমন স্থানে মোবাইল ফোনের টাওয়ার স্থাপন অবশ্যই রহস্যজনক।

সরেজমিন টেকনাফ-মিয়ানমার সীমান্তের নাফ নদীতে স্থাপিত ৫৫০ মিটার দীর্ঘ জেটিতে অবস্থানকালে কথা হয় কর্তব্যরত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নায়েক আবুল কালামের সঙ্গে। আলাপকালে তিনি বলেন, এসব টাওয়ার ব্যবহার করে আগে ব্যাপক ইয়াবা চালান লেনদেন হয়েছে। তবে এখন সেটি অনেক কমে গেছে। টাওয়ারের কার্যকরী সীমানাও কমিয়ে দেওয়ার কথা শুনেছি। তাছাড়া বর্তমানে বিজিবিসহ অন্যান্য বাহিনীও আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর ও সজাগ দৃষ্টিতে দায়িত্ব পালন করছে।

টেকনাফের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাদকের গডফাদার খ্যাত টেকনাফের আলোচিত সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির নির্দেশেই টাওয়ারগুলো জনবসতিহীন ও বনজঙ্গলে ঘেরা নদীর তীরে স্থাপন করা হয়। এসব টাওয়ার স্থাপনের পর থেকে টেকনাফ-কক্সবাজারের মাদকের গডফাদারদের সঙ্গে নাফ নদীর ওপারের (মিয়ানমার) মাদক ব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে ইয়াবা কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনী তথা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরাও তাদের স্বার্থে বাংলাদেশি সিমকার্ড ব্যবহার করছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মাদক ব্যবসায়ী ও নাসাকা বাহিনীর সদস্যদের হাতে হাজার হাজার বাংলাদেশি সিমকার্ড রয়েছে বলে মনে করে স্থানীয়রা। এসব সিমের নম্বরেই দু’পারের মাদকচক্রের মধ্যে ইয়াবা চোরাচালান সরবরাহ সংক্রান্ত যোগাযোগ হয়ে থাকে। এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেই বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীর অবস্থান ও কর্মতৎপরতা জানতে পারছে মিয়ানমারের মাদকচক্র ও তাদের সীমান্তরক্ষীরা, যা কেবল মাদক ব্যবসায় নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যও বড় হুমকি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেকনাফের মোট বাসিন্দাদের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ স্বাধীনতার আগে ও পরপরই রাখাইন থেকে চলে এসে স্থায়ী হয়েছে। এখন তারা বাংলাদেশি হলেও রাখাইনে (আরাকান) তাদের বংশীয় বা নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। এমনকি দেড় বছর আগেও টেকনাফ ও রাখাইনের বাসিন্দাদের মধ্যে অবাধ বা নির্বিঘœ যাতায়াত ও মেলামেশা ছিল। পাশাপাশি এই যোগাযোগকে আরও সহজ করে দেয় নাফ নদীর তীরে স্থাপিত একাধিক মোবাইল ফোনের টাওয়ার। টেকনাফের চক্ররা তাদের নামে সিম কিনে সেগুলো রাখাইনের চক্রের হাতে দিত। এভাবেই মোবাইল ফোনের যোগাযোগ ও অবাধ যাতায়াত-মেলামেশার সুযোগেই ইয়াবার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় টেকনাফ তথা কক্সবাজার অঞ্চল। যার ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে সারা দেশ। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে গত বছরের ৪ মে থেকে মাদকবিরোধী কঠোর অভিযান শুরু হলে নাফ নদীর এই সীমান্ত দিয়ে অবাধ চলাচল অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। তবে মোবাইল ফোনের সেই যোগাযোগ এখনও রয়েছে। বিভিন্ন পয়েন্টে মাদকচক্র আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পেছনে সোর্স মোতায়েন করে ওই মোবাইল ফোন যোগাযোগের মাধ্যমে ইয়াবার চালান বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করাচ্ছে।

সূত্র: সময়ের আলো।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন

ওয়েবসাইটের কোন কনটেন্ট অনুমতি ব্যতিত কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Design & Developed BY ThemesBazar.Com